শনিবার, ২৮ Jun ২০২৫, ০৬:৩৬ অপরাহ্ন

দৃষ্টি দিন:
সম্মানিত পাঠক, আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিমুহূর্তের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন -www.coxsbazarvoice.com, আর নতুন নতুন ভিডিও পেতে সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল Cox's Bazar Voice. ফেসবুক পেজে লাইক দিয়ে শেয়ার করুন এবং কমেন্ট করুন। ধন্যবাদ।

বরাবর মহান অসাধু ব্যবসায়ী

মুফতি আতিকুর রহমান:
দুয়ারে কড়া নাড়ছে অপার মহিমার মাস রমজান। এই মাসকে ইবাদত বন্দেগির দ্বারা সুসজ্জিত করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত হচ্ছেন দেশের ধর্মপ্রাণ মুমিন মুসলমানরা। অপর দিকে দেশের একশ্রেণির ধূর্তবাজ গোষ্ঠী এ মাসকে কেন্দ্র করে লালসার অপার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে তাদের প্রস্তুতি সেরে ফেলেছেন! বলছি অসাধু ব্যবসায়ীদের কথা। যেখানে রমজানের আবহে মানুষ সংযত হয় এবং ক্ষুধার তীব্রতায় জ্বলে-পুড়ে মানুষের পাপ-পঙ্কিলতা শোধন হয়, সেখানে অসাধু ব্যবসায়ীদের রোজা সংযত করতে পারে না কেন? নিশ্চয় তারা অসাধু বলে! হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা, প্রতারণা ও গুনাহের কাজ ত্যাগ করে না, আল্লাহতায়ালার কাছে তার পানাহার থেকে বিরত থাকার কোনো মূল্য নেই।’ -(আবু দাউদ) কেউ রোজা রাখবে আবার প্রতারণাও করবে, রোজা এমন লোকের আত্মিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটাবে না। রোজার উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া অর্জন করা। তাকওয়া অর্জনের জন্য মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের লালসা ত্যাগ করতে হবে।

স্বাভাবিকভাবে রমজান মাসে কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের চাহিদা বেড়ে যায়। সেগুলোর মধ্যে চাল, ভোজ্য তেল, চিনি, ছোলা, খেজুর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ অতিরিক্ত চাহিদাকে পুঁজি করে প্রতি বছর রমজান মাসে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী ও মজুদদারের আবির্ভাব ঘটে। তাদের সঙ্গে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী যোগদান করে। পণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলে মূল্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকে না। কিন্তু তারা মজুদদারির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও খাদ্যসামগ্রীর কৃত্রিম সংকট তৈরি করে মূল্য বাড়ায়। এর ফলে তারা অধিক হারে মুনাফা লুটে নেয়। ফলস্বরূপ তা দেশের সীমিত আয়ের লোকদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। রমজান এলেই দেশের জনগণ তাদের কাছে একপ্রকার জিম্মি হয়ে যায়। এভাবে মজুদদারি করা রাষ্ট্রীয় আইনে অনেক বড় অপরাধ। আর রমজান মাসে এমন অপরাধ করলে তা ভয়াবহ শাস্তির কারণ হবে। হাদিসে এমন কাজ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘পাপাচারী ছাড়া অন্য কেউ মজুদদারি করে না।’-তিরমিজি

অসাধু ব্যবসায়ীদের একটি মনোভাব হলো, তারা রমজানের এক মাস ব্যবসা করবে। আর সারা বছর আরামে কাটাবে। যে কারণে তারা রমজান মাসে মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করতে চায়। দাম বাড়ানোর প্রশ্নে খুচরা বিক্রেতারা দোষ দেয় পাইকারি বিক্রেতাদের, পাইকারি বিক্রেতারা দোষ দেয় আমদানিকারকদের। আর আমদানিকারকরা কারণ হিসেবে আমদানি শুল্ক, পরিবহন ব্যয়, চাঁদাবাজি ইত্যাদির কথা বলে। প্রতি বছর এভাবে একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দায় এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এটি একপ্রকার দায়হীনতার সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে।

প্রতি বছর পবিত্র রমজান মাসকে সামনে রেখে পৃথিবীব্যাপী অন্যরকম প্রস্তুতি থাকে। ২০২৪ সালের পবিত্র রমজান উপলক্ষে প্রায় ১০ হাজার পণ্য-দ্রব্যের দাম কমিয়েছে আরব আমিরাত। দাম কমানো ওই দ্রব্যগুলোর প্রায় ৮০ শতাংশই অত্যাবশ্যকীয় খাদ্যদ্রব্য। তাছাড়া ভোজ্য তেল, ময়দা এবং চালের মতো প্রধান মুদিপণ্যের দাম ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়েছে। খালিজ টাইমসের সূত্রে জানা যায়, গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকেই পণ্যের এই মূল্যছাড় শুরু হয়েছে। কিন্তু বিষয়টি আমাদের দেশে ব্যতিক্রম। রমজান আসার আগে থেকেই আমাদের দেশের জনগণ এক ধরনের আতঙ্কে থাকেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে। তবে সরকারপ্রধান প্রতি বছরের মতো এ বছরও রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার আশ্বাস দিয়েছেন।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, গত ১৫ জানুয়ারি বর্তমান সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী রমজানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার বিশেষ নির্দেশ দিয়েছেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদ অধিবেশনের প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী জানান, ‘সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের মূল্য স্বাভাবিক রাখতে সব কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ সবচেয়ে আশার কথা হলো, গত ৮ ফেব্রুয়ারি চার ধরনের পণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক কমানোর প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। পণ্যগুলো হলো : চাল, ভোজ্য তেল, চিনি ও খেজুর। সংবাদ মাধ্যমে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, ১ মার্চ থেকে এই চারটি পণ্য কম দামে বিক্রি করতে হবে। ব্যতিক্রম ঘটলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। খাদ্য মজুদ সংক্রান্ত আইন ২০২৩ অনুযায়ী নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি খাদ্যপণ্য মজুদ করলে যাবজ্জীবন বা সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু এই আইন কি আদৌ প্রয়োগ হবে?

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খাদ্যে ভেজাল মেশানো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আর সারা বছর খাদ্যে ভেজাল মেশানোর প্রবণতা স্বাভাবিক থাকলেও রমজান এলে ভেজালের তৎপরতা আরও বেড়ে যায়। ফুটপাত থেকে অভিজাত হোটেল রেস্তোরাঁ কোনোটাই ভেজালমুক্ত নয়। মহাখালী পাবলিক হেলথ ইনস্টিটিউটের খাদ্য পরীক্ষাগারের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫৪ ভাগ খাদ্যপণ্য ভেজাল এবং তা দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫-গ ধারায় বলা হয়েছে, খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। দেশের ৫৪ শতাংশ খাদ্যপণ্যে ভেজাল এবং দেশের আইনে এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ড! আইনের প্রয়োগটা কোথায়? সচরাচর চোখে পড়ে না! অসাধু ব্যবসায়ীরা মৃত্যুদণ্ডের শাস্তির মতো অপরাধ দিব্যি করে যাচ্ছে। কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা কত ক্ষমতাধর! রাসুল (সা.) এমন ব্যবসায়ীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহা অপরাধী হিসেবে উত্থিত হবে। তবে যারা আল্লাহকে ভয় করবে, নেকভাবে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যবসা করবে তারা ছাড়া।’ (তিরমিজি) রাসুল (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি মূল্যবৃদ্ধির অসদুদ্দেশ্যে মুসলমানদের লেনদেনে হস্তক্ষেপ করবে, কেয়ামতের দিন আল্লাহতায়ালা তাকে আগুনের হাঁড়িতে বসিয়ে শাস্তি দেবেন।’ (তাবরানি)

মানুষ মনে করে, শুধু নামাজ না পড়লে, রোজা না রাখলে, হজ না করলে বা জাকাত না দিলে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে হবে। অথচ ব্যবসায়ে প্রতারণা ও ঠকবাজি করলে পাপী হিসেবে সাব্যস্ত হতে হবে এবং জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে, এই বোধটুকু দেশের ব্যবসায়ীদের কবে জাগ্রত হবে? বিষয়টি তাদের অনুধাবন করা জরুরি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

atikr2047@gmail.com

ভয়েস/আআ

Please Share This Post in Your Social Media

© All rights reserved © 2023
Developed by : JM IT SOLUTION